‘মুড়ির ডালাটা আর মাথায় নিয়ে চলতে পারি না।একটা চোঁখ আমার অন্ধ।একদিন স্টোক হয়ে পড়ে ছিলাম এই পার্কেই।এখানে আসা ছাত্র-ছাত্রীরাই বাড়ি পৌছে দিয়েছিলো।পা আর না চললেও, কি করমু। খাইতে তো হইবো।পোলাপানের( পার্কে আগত বাচ্চাদের) মুখের রুচির উপরই নির্ভর করে আমার বাড়ির চুলা জ¦লবে কি না।’
আক্ষেপের সূরে কথা গুলো বলছিলেন ৮০ বছরের বৃদ্ধ ঝালমুড়ি বিক্রেতা গেদা মিয়া।মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কাযালয়ের পাশেই মুক্তিযোদ্ধা শিশু পার্ক।এই পার্কেই ঝালমুড়ি বিক্রি করেন তিনি জেলা শহরের বান্দুটিয়া গ্রামেই জন্ম মো: ফজলুর রহমান ওরফে গেদা মিয়ার।গেদা মিয়া ছোট থাকতেই অভাবের তাড়নায় বসতভিটা বিক্রি করে দেন গেদা মিয়ার বাবা।
ছোট থাকতেই সংসারের হাল ধরতে হয় গেদা মিয়াকে। দিনমজুরের কাজ দিয়ে জীবন শুরু করলেও বিয়ের পর স্ত্রী আর ২ মেয়ে নিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর হয় গেদা মিয়ার। তারপর একটু বাড়তি আয়ের আশায় শুরু করেন রিক্সা চালানো।একটানা ৩০ বছর রিক্সা চালানোর পর শরীর রিক্সা টানতে অপারগতা প্রকাশ করে ।আবার ফিরে আসেন দিনমজুরের কাজে।কিন্তু বেশি দিন এ কাজেও টিকে থাকতে পারলেন না তিনি।কারন মাথায় করে বোঝা বহনকরা ও অনেক শক্তির কাজ আর তিনি করতে পারেন না।কেউ আর কমজোর গেদা মিয়াকে কামলা নেয় না।
পেটের দায়ে এবার ঝালমুড়ি নিয়ে জীবন সংগ্রামে নামেন তিনি।মানিকগঞ্জ বিজয়মেলা মাঠ আর মুক্তিযোদ্ধা শিশুপার্কেই ঝালমুড়ি বিক্রি করেন তিনি।সকাল,দুপুর আর বিকাল বলতে গেলে সারা দিনই ঝালমুড়ির ডালা নিয়ে বসে থাকেন গেদা মিয়া।এখন আর কেউ তার নাম জানে না।সবাই ডাকে ”ঝালমুড়ি চাচা” নামে।সবাই ছোট বাচ্চা নিয়ে বিকেলে আসেন মাঠে বা পার্কে,সকালে স্কুলের ছেলে-মেয়েরা, উঠতি বয়সের যুগলরা সবাই আনন্দের সাথেই সময় কাটায়।অনেকেই ঝালমুড়ি চাচার সাথে ঠাট্টা-তামাশাও করেন। কিন্তু কেউ ঝালমুড়ি চাচার হৃদয়ের কান্নার কথা জিঙ্গেস করেন না। কথা গুলো বলার সময় গেদামিয়ার দু’চোঁখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিলো।
তিনি জানান,দুটি মেয়েই বিয়ে দিয়েছি অত্যন্ত দরিদ্র ঘরে।বড় মেয়ের চার কন্যা সন্তান হয়েছে।স্বামী রংমিস্ত্রীর সহযোগি।ছোট মেয়ের এক ছেলে এক মেয়ে।তাদের কারো সংসার ঠিকমত চলে না। তারা কিভাবে আমাকে দেখবে।মাসে ২হাজার টাকা ঘর ভাড়া দিয়ে নিজের গ্রামেই থাকেন তিনি।বয়স্ক ভাতা বাবদ মাসে ৫০০ টাকা করে পান। তবে গৃহহীন এ অসহায় মানুষটার ভাগ্যে আজও জোটেনি কোন আবাসন সুবিধা। পাননি সরকারি কোন ঘর।
দুটি চোখেই ছানি পড়ে প্রায় সম্পূর্ন অন্ধ হয়ে পড়েছিলেন গেদা মিয়া। পড়ে নিজের জমানো টাকা আর মেয়েদের থেকে ১০ হাজার টাকা ধার করে একটি চোঁখের অপারেশন করেন।কিন্তু টাকার অভাবে বাম চোঁখটা এখনো অপারেশন করাতে পারেননি। দুনিয়ার আলো দেখতে পাচ্ছেন তিনি।টাকার অভাবে বাম চোখের অপারেশন করাতে পারছেন না।এ ব্যাপারে কেউ সহযোগীতাও করছেন না।
তবে খুবই আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন আর নীতিবান মানুষ গেদা মিয়া।কারো কাছে হাত পাতেন (ভিক্ষা করেন) কি না? এমন কথায় মনে খুবই কষ্ট পান তিনি বলেন,যতক্ষন চলতে পারবো কাজ করে খাবো। আর যখন ঘরে পড়ে থাকবো তখন আল্লাহই দেখবেন। ভিক্ষা করা না আমার নবীর (সাঃ) শিক্ষা নয়। তবে কেউ সহযোগিতা করলে সেটা তো নেয়াই যায় কারন আমি এখন প্রায় অচল একটা মানুষ। ঘরে বৃদ্ধা স্ত্রীও অসুস্থ।
তিনি জানান ,গরমের কারনে ঝালমুড়ি লোকজন কম খাচ্ছে আর আমার বিক্রিও কমে গেছে আজ সারা দিনে মাত্র ১০০টাকা বিক্রি করেছি।দিনে ভালো বিক্রি হলে ৪ থেকে ৫শত টাকা বিক্রি হয়। আর তাতে তার লাভ থাকে ২৫০ টাকার মতো। কিন্তু গত ৩ মাস যাবত ১৫০ টাকার উপর বিক্রি হচ্ছে না। তাছাড়া স্টোকের পর হতেই হাত-পা কাপেঁ গেদা মিয়ার।মুড়ি বানাতে গেলেও হাত কাপঁতে থাকে।
ঘর ভাড়া বাকি পড়েছে।রান্নার লাকড়ি নাই ,স্ত্রী সারা দিনে কুড়িয়ে কিছু কাগজ-লাকড়ি পায় তাই দিয়েই রান্নার কাজ চলে।ধার্মিক আর ৫ ওয়াক্ত নামাজি গেদা মিয়া মুড়ির ডালা পার্কে রেখেই নিয়মিত কোর্ট মসজিদে নামাজ আদায় করেন।কেমন চলে আপনার সংসার,এ প্রশ্নের উত্তরে গেদা মিয়া বলেন,ভাতের টাকাই তো জোগার করতে পারি না আর মাছ-মাংসের কথা তো ভুলেই গেছি।শুধু নিরামিষ খেয়ে বেঁছে আছি।তবে এলাকায় কোন মিলাদ বা অনুষ্ঠান হলে কেউ দাওয়াত দিলে তখন একটু মাংস জুটে কপালে।
তিনি বলেন,কোন হৃদয়বান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি আমার চোখের ছানি অপারেশন করে দিতো তাহলে আল্লাহর কাছে তার জন্যে অনেক দোয়া করতাম। আর শুনেছি সরকার নাকি গৃহহীনদের থাকার জায়গা দেয়। আমাকে যদি দিতো, মাথা গোজারস্থান পেতাম।ঘর ভাড়া পরিশোধ করতে গিয়ে আর না খেয়ে থাকতে হতো না। তার মুড়ির ডালার নিচ হতে একটা মোবাইল নাম্বার বের করে দিয়ে তিনি বলেন ,আমি যদি কখনও কোন বিপদে পরি, তাই এই নাম্বারটা আমার মেয়ে দিয়েছে ( ০১৭৭৮-৬৫৯৭২০)
জেপি/নি-১৭/শাহানুর ইসলাম